কবি সিরাজুল ইসলাম, বাসস্থান-নজরগঞ্জ ( হলুদিয়া পাখি সোনার বরন গানটির রচয়িতা )
ইসলামী সাহিত্যের অমর সৃষ্টি বিখ্যাত গজল ‘নবী মোর পরশ মণি, নবী মোর সোনার খনি’, ‘আল্লাহু আল্লাহু, তুমি জাল্লে জালালুহু’, ‘হলুদিয়া পাখি সোনারি বরণ পাখিটি ছাড়িল কে’সহ শত শত বিখ্যাত গানের লেখক, গীতিকার কবি সিরাজুল ইসলামের নামে কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন চত্বরে প্রতিষ্ঠিত কবি সিরাজুল ইসলাম পাবলিক লাইব্রেরিতে স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। অন্য দিকে কবির নিজ হাতে গড়া তার নিজ বাড়িতে বই বাগান নামের প্রতিষ্ঠানটিও এখন ধ্বংসের মুখে। এলাকাবাসী কবির স্মৃতিবিজড়িত পাঠাগার, বই বাগান ও তার লেখা বই রক্ষার জন্য সরকারি উদ্যোগ কামনা করেন।
এ দেশের চলচ্চিত্র তথা সাংস্কৃতিক জগতের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম কবি সিরাজুল ইসলাম। পঞ্চাশ দশকের গোড়া থেকেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। মাহেন ও মোহাম্মদী, দিলরুবা, পাকিস্তানী খবর, পাক জমহুরিয়াত, দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, মিল্লাত, সংবাদ, সৈনিক, পূর্বদেশ, কৃষি কথা, বেতারবাংলা, শুকতারা, দিনকাল, যুগান্তরসহ বহু পত্রপত্রিকায় তার লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৩০ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার রসুলপুর গকুলচর গ্রামে কবির জন্ম। রক্ষণশীল সামাজিক প্রথা ভেঙে তিনি ১৯৪৮ সালে সঙ্গীতে তালিম নেন এবং গান লেখাও সুরারোপ শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি রেডিওর গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হলে তিনি সেখানেও গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। হিজ মাস্টার ভয়েজের তিনি অন্যতম গীতিকার ও সুরকার।
আল্লাহ আল্লাহু তুমি জাল্লে জালালু, নবী মোর পরশ মণি, নবী মোর সোনার খনি, মন ভোমরা মজলি না তুই রসুল নামের বশে, এখনও সময় আছে আল্লাহ নবীর নাম লও, হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িলো কে, বলে দাও মাটির পৃথিবী কোথা শান্তি আমার জীবনে, কোকিল ডাকিস নারে আর, এলো বসন্তের বাহার, কে যাও তুমি ভাটির দেশে ও বিদেশী নাইয়া, এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া এগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে কবি সিরাজুল ইসলামের নাম। এছাড়া আধুনিক, দেশাত্মবোধক, মারফতি, মুর্শিদী, মরমী ইত্যাদির প্রকারের তার কয়েক শ’ গান বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের ডিস্কে রেকর্ড রয়েছে।
কবি সিরাজুল ইসলামের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী সরদার আলাউদ্দিন, আব্দুল আলীম, ফেরদৌসী রহমান, মাহমুদুন নবী, ফরিদা ইয়াসমীন, খন্দকার ফারুক আহমেদ, খুরশিদ আলম, সাবিনা ইয়াসমীন, শাহনাজ রহমাতুল্লাহ, মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার, ফওজিয়া খান, বশির আহমেদ, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, নাদিরা বেগম, রওশানারা চৌধুরী, সুবির নন্দী ও আব্দুর রউফসহ খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পীরা।
সিরাজুল ইসলামের লেখা বইয়ের সংখ্যা ২৫টি। এর মধ্যে হলুদিয়া পাখি, রক্তিম আলিঙ্গন, রক্তপলাশ, যে গান অনির্বাণ, দুটি পাখি একটি নীড়, আকাশ মাটি মানুষ মন, সময়ের নীল সাঁকো সত্যের সৌরভ, হীরন্ময় জ্যোতির্মালা, বন্ধু ওগো সুপ্রভাত, আমি মুক্ত বলাকা, গানের গোলাপ, সুজন নাইয়া, নকশী সপ্তক ও শান্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা অন্যতম। ১৯৭৫ সালে কেরানীগঞ্জের রক্তারুণ শিল্পীগোষ্ঠী তাকে সংবর্ধনা পদক দেয়। ১৯৮৬ সালে তাকে বাংলাদেশ সিরাত মিশন ও বাংলাদেশ কল্যাণ সংস্থা পুরস্কার প্রদান করে।
কবি সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বাংলা একাডেমি এবং কেরানীগঞ্জ প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য। কর্মজীবনে তিনি কয়েকটি প্রাইভেট ফার্মে সামান্য বেতনে একজন সাধারণ হিসাব রক্ষকের কাজ করতেন। তার নিজের সঞ্চিত কোনো অর্থ ছিল না, যা ছিল নিজ বাড়িতে বই বাগান নামক একটি পাঠাগারে তার সবই দান করে গেছেন। একপর্যায়ে চোখ অপারেশন করার ফলে প্রচণ্ড আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে যান তিনি। সে সময় কেউ কবির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। তাই শেষ বয়সে আর্থিক দুর্দশায় পতিত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন।
জীবিত থাকা অবস্থায় কবি সিরাজুল ইসলামের খোঁজ-খবর কেউ না নিলেও মৃত্যুর পরে উপজেলা প্রশাসন ভবনের একটি অংশ ব্যবহৃত হয়েছিল কবি সিরাজুল ইসলামের পাঠাগার হিসেবে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান ২০০২ সালের ২৭ জুলাই ভবনটি কবি সিরাজুল ইসলাম পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে বরাদ্দ দেন। প্রায় এক যুগ আগে সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপিত হয়। এর পর থেকে শিক্ষার্থীসহ সব বয়সের মানুষ বই পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কবির পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, কবি সিরাজুল ইসলামের স্মরণে ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে কেরানীগঞ্জ উপজেলা চত্বরে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। এ পাঠাগারে কবি সিরাজুলের রচিত বিভিন্ন ধরনের গানের সংকলন ও বই এবং তার কর্মজীবন সম্পর্কে বিভিন্ন বই রাখা হতো। এ ছাড়া শিক্ষার্থী ও সব ধরনের লোকজনের জ্ঞান আহরণের জন্য বিভিন্ন রকম শিক্ষামূলক বই ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো; কিন্তু ২০০৭ সালের শেষ দিকে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কবি সিরাজুল ইসলাম পাবলিক লাইব্রেরিটি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়।
এলাকাবাসী জানায়, আগে আমরা পাঠাগারে এসে নিয়মিত পত্রিকা ও বই পড়তাম; কিন্তু সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি থাকায় সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তারা বলেন, পাঠাগারে এক সময় অনেক দুর্লভ বই পাওয়া যেত। কিন্তু সে বইগুলো এখন আর পড়তে পারছেন না তারা।
এ ব্যাপারে কোনাখোলা পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক নির্মল কুমার দাস বলেন, কোনাখোলা পুলিশ ফাঁড়িতে তিনি ছাড়াও দুইজন এসআই, একজন এএসআইসহ ১৬ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। তিনি বলেন, তারা নিজেদের ভবনের জন্য জমি খুঁজছেন। তাদের নিজেদের জন্য একটি স্থায়ী ভবন নির্মাণ হলে তারা এই পাঠাগার ছেড়ে দিবেন।
অন্য দিকে কবি সিরাজুল ইসলামের নিজ বাড়ি রসুলপুর (গকুলচর) গ্রামে তার রেখে যাওয়া বই বাগানটি এখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। কবির নিজ হাতে গড়া ‘বই বাগান’ নামক ওই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য কবি সিরাজুল ইসলাম স্মৃতি সংসদ নামক একটি কমিটি গঠন হলেও গত আট বছর ধরে তার কোনো কার্যক্রম নেই।
কবি সিরাজুল ইসলামের পুত্রবধূ খালেদা আক্তার সিমা নয়া দিগন্ত প্রতিনিধিকে জানান, স্মৃতি সংসদের লোকজন কবির নাম ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে। তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে তা আত্মসাৎ করছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য পাঠানো ৫০ হাজার টাকার একাধিক চেক গায়েব করে দিয়েছে। কবির নামে কোনো অনুষ্ঠান করলে তা কবির পরিবারের কাউকে জানানো হয় না। তিনি আরো বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান এলাকার এমপি থাকাবস্থায় তাদের খোঁজখবর নিয়েছিলেন। কবির বাড়ির রাস্তার উন্নয়নের জন্য চাল বরাদ্দ দিয়েছিলেন; কিন্তু স্মৃতি সংসদের কোনো লোকজন তাদের খোঁজ-খবর নেয়নি। এমনকি কবির লেখা বই তারা বই বাগান থেকে নিয়ে গেছে। যার কারণে অনেক বইয়ের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। অযতেœ অবহেলায় দীর্ঘ দিন পড়েছিল বই বাগান ও তার কবর। পরে নিজেরাই অর্থ জোগাড় করে পারিবারিকভাবে কবর ও লাইব্রেরি ধোয়ামোছা করে রঙ লাগিয়েছেন। এসব কাজে স্মৃতি সংসদের লোকজন কোনো সহযোগিতা করেনি।
এ ব্যাপারে কবি সিরাজুল ইসলাম স্মৃতি সংসদের সভাপতি ও বিএনপি নেতা হাজী নাজিম উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কবির পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। পরিবারের কেউ কোনো কাজে সহযোগিতা করেন না। তাছাড়া কবির মেয়ের জামাতা কবির ওয়াকফ করে দেয়া জমি আত্মসাতের চেষ্টা করছে। তাই কাজ করে কোনো সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি অর্থ আত্মসাতের কথা অস্বীকার করে জানান, যা খরচ হয়েছে তার সব ভাউচার আছে।
কেরানীগঞ্জের বর্তমান প্রজন্ম কবি সিরাজুল ইসলাম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তবে স্থানীয় কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে কথা বললে তারা জানান, কবি সিরাজুল ইসলাম একজন বড় মাপের কবি। আমাদের দেশে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পরে কবি সিরাজুল ইসলামই ইসলামী গান লিখেছেন। তার স্মৃতিবিজড়িত বই বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ হওয়া উচিত। এজন্য তারা সরকারের উদ্যোগ কামনা করেন।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস